২০১২ সাল। হাঙ্গেরিয়ান পদার্থবিদেরা ভীষণ উত্ফুল্ল। ছোট্ট একটা পরীক্ষা যে কখনোসখনো বড় ফল এনে দেয়, যা নাকি একেবারেই অপ্রত্যাশিত, এমন কিছু ঘটলে তো বিজ্ঞানীরা উত্ফুল্ল হবেনই। সেই গবেষকদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডেব্রেসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারের পদার্থবিদ আত্তিলা কার্জন্যাহরকে।
একটা ছোট্ট সাধারণ কণা ডিটেক্টর নিয়ে কাজ করছিলেন তাঁরা। হঠাত্ ডিটেক্টরে অন্য রকম একটা কণার সন্ধান পান বিজ্ঞানী দল। কণাটি খুব হালকা। ভর ৩৪টি ইলেকট্রনের সমান।
সেটার চরিত্র বোঝার জন্য চলল তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু পদার্থবিদ্যার যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল, তাতে যে কটি কণা ঠাঁই পেয়েছে, তার কোনোটির সঙ্গেই মেলে না কণাটির চরিত্র। তার মানে, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের চেনাজানা গণ্ডির বাইরের কোথাও থেকে হাজির হয়েছে কণাটি!
তাহলে কি তাঁদের হিসাবে কোনো ভুল হলো? ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। আবার তাঁরা পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এবারও একই ফল। কী এই কণা? আবার শুরু হলো তাঁদের হিসাব-নিকাশ। শেষমেশ বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন, এটাই ডার্ক ফোটন। সেটা আবার কী? ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির নাম নিশ্চয় অজানা নয়। বাংলায় যাদের অনেকে গুপ্তপদার্থ ও গুপ্তশক্তি বলে।
সেই ডার্ক ম্যাটারের জন্য মহাবিশ্বে একধরনের বলের দরকার হয়। সেই বলের জন্য দায়ী যে কণা, সেটাই হচ্ছে ডার্ক ফোটন।
ডার্ক ফোটন নামটা নেওয়া হয়েছে আরেকটা বলবাহী কণা ফোটনের নাম থেকে। ফোটন হলো আলোর কণা। ইলেকট্রন, প্রোটনের কিংবা কোয়ার্কের মতো বস্তুকণা নয়। আমরা যে আলোর সাহায্যে দেখি, সেটা একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ প্রকৃতির। আলোর সেই কণাকেই ফোটন বলে। ফোটন আবার দুই রকমের-বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল ফোটন। পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনরা যখন এক উচ্চ শক্তি স্তর থেকে নিম্ন শক্তি স্তরে নেমে আসে, তখন আমরা যে ফোটন দেখি, সেগুলো বাস্তব কণা। আবার বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের জন্য দায়ী কণারা হলো ভার্চ্যুয়াল ফোটন। একটা চার্জিত কণা যখন ত্বরিত হয় বা বৃত্তাকার পথে ঘোরে, তখন সেই কণা বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। আবার চার্জিত কণা বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে। অর্থাত্ তার যে বৈদ্যুতিক প্রভাব, সেটা ছড়িয়ে রাখে শূন্যস্থানে। আরেকটি চার্জিত কণা যখন সেই বিদ্যুৎক্ষেত্রে আসে, তখন সে এক ধরনের বল অনুভব করে। সেই বলই হলো বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল। এ কথা একটা চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যও সত্যি। একটা চুম্বক তার চৌম্বকীয় প্রভাব ছড়িয়ে রাখে শূন্যস্থানের ভেতর। আরেকটা চৌম্বকীয় পদার্থ সেই ক্ষেত্রের ভেতর এলে চৌম্বক বল অনুভব করে। এটাও আসলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল। বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই দেখিয়েছেন, চুম্বক আর বিদ্যুত্ একই বলের আলাদা রূপ। আর বৈদ্যুতিক চার্জ আর চুম্বক শূন্যস্থানে যে বল ছড়িয়ে রাখে, সেগুলো আসলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ আকারে। আবার আলো, যার সঙ্গে আমাদের নিত্য বসবাস, সেটাও কিন্তু বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। পরমাণুর ভেতর প্রোটন আর ইলেকট্রনের ভেতর যে আকর্ষণ, যে কারণে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, সেই আকর্ষণ বল আসলে একধরনের বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলই। আর এই বিদ্যুত্চুম্বক যে তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়ে, তার পেছনে ভূমিকা রয়েছে ভার্চ্যুয়াল ফোটনদের।
মহাবিশ্বে আরও তিনটি বল সক্রিয়। সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল আর মহাকর্ষ বল। সবল নিউক্লীয় বল ক্রিয়া করে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর। নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন আর চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে। তাদের এই শক্তিশালী বন্ধনের রহস্য কী? বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে একসময় বিরাট ঝামেলায় পড়েছিলেন। পরে প্রমাণ হয়, এর পেছনে সম্পূর্ণ নতুন এক বল কাজ করে। বিজ্ঞানীরা এই বলের নাম দিলেন সবল নিউক্লীয় বল। চার বলের মধ্যে এই বলই সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু পাল্লা খুব কম। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যেই এর যত জারিজুরি। তার বাইরে এর বাহাদুরি চলে না। কিন্তু এই বলের জন্য দায়ী কোনো কণা আছে কি? বিজ্ঞানীরা একটা সময় মনে করতেন, মেসন নামের একধরনের কণা এই বলের বাহক হিসেবে কাজ করে। পরে তাঁরা জানতে পারেন, মেসন নিজেই মূল কণিকা নয়। এগুলো কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। মূল কণিকা নয় নিউট্রন কিংবা প্রোটনও। এরাও কোয়ার্ক তৈরি দিয়ে। নিউট্রন, প্রোটন আর মেসনের ভেতরে কোয়ার্কগুলোকে আটকে রাখে গ্লুয়ন নামের বলবাহী কণা। এই গ্লুয়নই সবল নিউক্লীয় বলের বাহক কণা।
হাইড্রোজেন কিংবা লোহা-বেশির ভাগ মৌলের নিউক্লিয়াস স্থিতিশীল। কিন্তু কিছু পরমাণুর নিউক্লিয়াস মোটেও সুখে-শান্তিতে থাকতে রাজি নয়। তাদের ভেতরের নিউক্লিয়নগুলোর মধ্যে যেন জন্মের আড়ি। সেই আড়ি থেকেই তাদের নিউট্রনগুলোর ভেতর ভাঙন ধরে। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে ক্রমাগত কমে যায়, পরিবর্তন হয় পারমাণবিক সংখ্যা। এক পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে পরিণত হয় আরেকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। কণা বিজ্ঞানীরা বলেন, এর পেছনে কাজ করে দুর্বল নিউক্লীয় বল। এই দুর্বল নিউক্লীয় বলের বাহক হলোW+, W- ও Z0 নামের তিনটি কণা।
চারটি বলের মধ্যে মহাকর্ষ সবচেয়ে দুর্বল। এর আকর্ষণ ক্ষমতা খুবই কম। কিন্তু বিস্তার অনেক বেশি, অসীম পর্যন্ত। এই বলের জন্য নিউটন বলেছিলেন বস্তুর ভর দায়ী। কিন্তু বস্তুর সেই ভরটা কোথায় থাকে, সেটা আজও মস্ত এক রহস্য। আইনস্টাইন বলেছিলেন, মহাকর্ষ হলো স্থান-কালের বক্রতার ফল। ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থান-কাল বাঁকিয়ে দেয়। সেই বাঁকানো স্থান-কালের ভেতর আরেকটি বস্তু এসে পড়লে মনে হয়, বস্তু দুটো পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু এই বল নিয়ে একটা ঝামেলা আছে। খুদে কণিকাদের জগতে এই বল কাজ করে না। আবার খুদে কণিকারা চিরায়ত বলবিদ্যার কোনো সূত্রই মানে না। তাই এদের জন্য তৈরি হয়েছে পদার্থবিদ্যার আরেকটা শাখা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। সেই বলবিদ্যা দিয়ে মহাবিশ্বের পুরোটা আবার ব্যাখ্যা করা যায় না। ভারী বস্তুর প্রকৃতি ব্যাখ্যায় আজও নিউটন-আইনস্টাইনের বলবিদ্যাই কার্যকর। মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য ব্যাখ্যার জন্য ১৯৭০-এর দশকে তিন পদার্থবিদ স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশো স্ট্যান্ড্যার্ড মডেল দাঁড় করান। সেই মডেলে স্থান পায় সব মূল কণিকার। বোসন আর ফার্মিয়ন এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করে। ফার্মিয়ন শ্রেণির কণাগুলো সাধারণ বস্তুকণা আর বোসন কণাগুলো হলো বলবাহী কণা। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষ বলের স্থান কোথায়? এটার সমাধান আজও হয়নি। তবে কণা পদার্থবিদেরা একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। বলেছেন, এক কল্পিত বলবাহী কণার কথা, সেটা গ্র্যাভিটন। সেটার কারণেই নাকি বস্তু মহাকর্ষ বল অনুভব করে। কিন্তু সেই বলবাহী কণার দেখা আজও পাননি বিজ্ঞানীরা।
এখন যেটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, এই চার বলই কি নিয়ন্ত্রণ করছে গোটা মহাবিশ্ব। তা হয়তো নয়। কারণ, মার্কিন বিজ্ঞানী ভেরা রুবিনের একটা তত্ত্ব। ১৯৭০-এর দশকে এই মার্কিন জ্যোতির্বিদ বললেন, এক আশ্চর্য কথা। মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির খুব সামান্য অংশই আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে, মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশই রয়ে গেছে গুপ্ত অবস্থায়। আমাদের প্রচলিত পদার্থবিদ্যার জ্ঞান দিয়ে আপাতত সেগুলোর হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। পরে বিজ্ঞানীরা একটা তথ্য বের করতে পারলেন। সেই গুপ্ত ভরশক্তির ৬৮ শতাংশ গুপ্ত শক্তির (Dark Energy) আকারে থাকে, বাকি ২৭ শতাংশ গুপ্ত পদার্থ (Dark Matter)। কিন্তু কেন এই গুপ্ত ভরশক্তির অবতারণা?
সমস্যাটার সূত্রপাত ১৯৩০-এর দশকে। ডাচ বিজ্ঞানী ইয়ান ওর্ট ও মার্কিন বিজ্ঞানী ফ্রিত্জ জুইকি মহাকাশে অদৃশ্য এক মহাকর্ষ প্রভাবের সন্ধান পেলেন। সেই মহাকর্ষীয় প্রভাবের জন্য মহাবিশ্বের কোনো বস্তুই দায়ী নয়। অচেনা বস্তু থেকে তৈরি সেই মহাকর্ষ বলের প্রভাব অনেক অনেক বেশি। তবে কি তাঁদের হিসাবে ভুল ছিল? প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি। ১৯৫৯ সাল, জ্যোতির্বিদ লুইস ভোল্ডারসের আরেকটি গবেষণা বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবিয়ে তুলল বিজ্ঞানী মহলকে। এরপরই ভেরা রুবিন সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই বিশাল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিকে আমলে নিয়েই বিগ ব্যাং, মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা করা যায় আইনস্টাইনের মহাকর্ষও। সুতরাং গুপ্তপদার্থ ও গুপ্তশক্তি নিয়ে আর কারও সন্দেহ থাকে না।
বিশ্বব্যাপী ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে চার দশক ধরে। কিন্তু এদের সন্ধান মেলেনি। বিজ্ঞানীরা দৃশ্যমান জগতের মতো ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিও নিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক সিস্টেম তৈরি করতে চাচ্ছেন। এরই প্রথম প্রয়াস হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব। তাঁরা মনে করেন, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল যেমন আমাদের চেনাজানা মহাবিশ্বকে দৃশ্যমান করছে, এর সম্পূর্ণ পরিচিতি তুলে ধরেছে আমাদের সামনে, তেমনি একটি বল নিয়ন্ত্রণ করছে গোটা গুপ্ত ভরশক্তির জগেক। হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানীরা গুপ্তজগতের সেই বলটিকেই বলছেন ডার্ক ফোর্স বা গুপ্তবল, যা নাকি মহাবিশ্বের পঞ্চম বল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বল যদি থাকে তাহলে সেই বলের বাহকেরও দরকার। অর্থাৎ এর জন্যও একটা বলবাহী বোসন কণা থাকতে হবে। আত্তিলা কার্জন্যাহরকে আর তাঁর দলটি বলছে, তাঁদের আবিষ্কার করা সেই রহস্যময় কণাটি আসলে ডার্ক ফোর্সের বাহক। তাঁরা ২০১৫ সালে আবার একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে তাঁরা দাবি করেন, পঞ্চম এই বল আর ডার্ক ফোটনই হবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মিসিং লিংক। প্রথম দিকে তাঁদের এই তত্ত্ব নিয়ে তেমন কেউ মাথা ঘামাননি। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল গবেষক হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলটিকে যাচাই করে দেখেন। তাঁরা এতে কোনো খুঁত খুঁজে পাননি। এ কথাও তাঁরা ফলাও করে প্রচার করেছেন। তাতেই টনক নড়েছে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। পঞ্চম বল আর ডার্ক ফোটন নিয়ে বিশ্বের বড় বিজ্ঞানীরা গবেষণা করবেন। হয় তাঁরা হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে প্রমাণ করবেন, নয়তো বাতিল হবে ৫ নম্বর বল আর গুপ্ত ফোটনের এই তত্ত্ব।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: পপুলার সায়েন্স